Select Language

[gtranslate]
২০শে জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ সোমবার ৩রা জুন, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

।। টেকনোলজির চক্রব্যূহে ।।

কল্যানী মিত্র ঘোষ :- আমার ফুলকাকা অসম্ভব মজার মজার গল্প বলতে পারতেন, সবটাই বানিয়ে। আমার বাবা ও দিদিমার বলা গল্প গুলো ছিল সত্য ঘটনা অবলম্বনে, তাই ফুলকাকা যেগুলো বলতেন সেগুলোতে আমরা অর্থাৎ আমি ও আমার তুতো ভাইবোনেরা প্রবল প্রতিবাদ জানাতাম অথবা হেসে গড়াগড়ি খেতাম। আমি ফুলকাকার নাম দিয়েছিলাম “গুলেন গড”। বানিয়ে বানিয়ে গপ্পো বলা কিন্তু চাট্টিখানি কথা নয়। ফুলকাকার জবানিতেই টেকনোলজির বাড় বাড়ন্তের দুটো গল্প বলি,

“সেবার তোর ফুলকাকিমা কে নিয়ে আমি জাপান গেলাম…”

ডাঁহা মিথ্যে কথা, আমরা সমস্বরে,

“ওমা তাই? সত্যি বলছো? কবে গেলে?”

সেটা ১৯৭৭ সাল, কাকা ১৯৬৫ সময়কালের কথা বলছিলেন। আমার এক জ্যাঠতুতো দাদা শিপিং কর্পোরেশনে খুব বড় পদে আসীন তখন এবং অনেক বছর জাপানে ছিলেন, হয়তো দাদার থেকেই কিছু কিছু শুনে থাকবেন, ঠিক জানিনা। আমরা ফুলকাকাকে ঘিরে অর্ধচন্দ্রাকারে বসেছি, কাকা বলে চলেন,

“হ্যাঁ তো, জিজ্ঞেস করিস তোর কাকিমা কে। তা আমরা তো সেই বিশাল একটা হোটেলে ঢুকলাম। তারপর রুমে গিয়ে হাতমুখ ধোবো, কল ধরে টানাটানি করি, জল আর আসেনা! এ কি দেশ রে বাবা, জল নেই! এরা আরশোলা খায় শুনেছি, সেই জন্যই কি জল আর লাগেনা? তোর কাকিমা তো খুব রেগে গেল, শেষে কলের তলায় খাবার জলের জাগ থেকে একটু জল ঢেলে দিলাম আর ও কলের নীচে হাত দিয়ে হাত ধুতে যাবে এমন সময় কলকল করে জল বেরিয়ে এলো, কি ভুতুড়ে কান্ড রে বাবা! আর বন্ধও করতে পারিনা, তোর কাকিমা হাত ধুয়েই চলেছে … এবার হাতে হাজা হয়ে যাবে। আমি বললাম হাত সরিয়ে নাও আমি নীচে গিয়ে কথা বলবো। ও হাত সরিয়ে নিতেই জল পড়া থেমে গেল। ব্যাপারটা বোঝ, হাত বাড়ালেই জল আর সরিয়ে নিলেই শুকনো!”

আমরা তো কিছুতেই বিশ্বাস করবো না, তখনও বিশ্বের অন্যান্য দেশের উন্নত টেকনোলজির কথা আমাদের কানে এসে পৌঁছায়নি, তাই আমাদের হাঁ করা মুখের দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে কাকা পরের গল্পটা শুরু করলেন।

“তোদের ফুলকাকিমা কে ঘরে রেখে আমি বেরোলাম খাবার আনতে, বলে গেলাম কোনো কিছুতে যেন হাত না দেয়। ঘন্টা দুয়েক পর ফিরে এসে দেখি ঘরে কেউ নেই। নাম ধরে কত ডাকাডাকি করলাম, নাহ্ কেউ কোত্থাও নেই! খুব চিন্তায় পড়লাম, এ কোন ভুতুড়ে জায়গায় এলাম রে বাবা, গোটা বউ গায়েব করে দিলো! ব্যস্ত সমস্ত হয়ে রিসেপশনে যেতে যাবো এমন সময় চিঁ চিঁ করে একটা আওয়াজ ভেসে এলো। মনে হলো যেন বিছানা থেকেই, এগিয়ে গেলাম ওর নাম ধরে ডাকতে ডাকতে, আওয়াজটা কাছে এসে গেল, কিন্তু বিছানাতে তো নেই, তবে? আরও ভালো করে বিছানা হাতড়াতে দেখি বিছানার মাঝখানটা পুরো ভাঁজ হয়ে গেছে, তার মধ্যে তোদের ফুলকাকিমা ঝুলে আছে! আসলে এতই নরম গদি যে কেউ শুলেই ওই রকম ভাঁজ হয়ে যাবে।”

এটাতে আমরা প্রবল চেঁচামেচি করেছি “গুউউল” বলে, কিন্তু আমেরিকাতে এসে কত রকমের যে বিছানা, তোষক দেখছি তার ইয়ত্তা নেই। আর সত্যিই অনেকটা ওই রকম তোষকও আছে ঠিক যেমন ভাবে শোবেন ওটাও ঠিক সেই রকম ভাবে শরীরের ভঙ্গিমার সঙ্গে খাপ খেয়ে একটা খোলস মতো তৈরী করবে, অর্থোপেডিক তোষক, প্রযুক্তির জয় জয়কার আর কি!

আমেরিকার স্যান ডিয়েগোতে এসেছি প্রায় আঠেরো বছর হলো, এদেশে সব কিছুর জন্যই যন্ত্রের ওপর নির্ভরশীল আমরা, রান্নার মাসী, ধোপা, কাজের দিদি, মালী ইত্যাদি সকলের কাজ একা হাতে সামলানো, তাই যন্ত্রই ভরসা। বিভিন্ন যন্ত্র আমাকে বিভিন্ন ভাবে নাকানি চোবানি খাইয়েছে, এখন মোটামুটি একটু ধাতস্থ হয়েছি। ক্যালিফোর্ণিয়ায় বর্তমানে গ্যাস বা গ্যাসোলিন অগ্নিমূল্য, আর গাড়ি ছাড়া এখানে এক পা ও চলা যায় না; কারণ জনসাধারণের জন্য পরিবহন ব্যবস্থা খুবই খারাপ। আজকাল কলকাতায় যেমন মধ্যবিত্ত পরিবারেও এসি মেশিন কিনতে হচ্ছে, সেখানে ওটাকে আর বিলাসিতা বলে ধরা হয় না, ঠিক সেরকমই ক্যালিফোর্ণিয়ার মানুষ বিদ্যুৎ চালিত গাড়ি “টেসলা” কিনতে বাধ্য হচ্ছে। আমাদের পরিবারেও কয়েক মাস হলো একটি টেসলার আগমন হয়েছে। সেটি কেনার সময় আমি মোটেই উৎসাহিত ছিলাম না, কারণ যতবারই বাড়িতে পুরনো গাড়ির বদলে একটি নতুন মডেলের গাড়ি এসেছে ততবারই তার উন্নত প্রযুক্তির সঙ্গে সড়গড় হতে আমাকে যথেষ্ট নাজেহাল হতে হয়েছে এবং বাড়িতে সেটা নিয়ে হাসাহাসিও কম হয়নি। এর মধ্যে গোদের ওপর বিষ ফোঁড়া এই টেসলা, টেকনোলজির একটি উৎকৃষ্ট উদাহরণ।

আমি ও কর্তা গাড়িটি ডেলিভারি নিতে গেলাম, ফেরার সময় উনি টেসলা চালিয়ে আসবেন আর আমি যে গাড়ি চড়ে আমরা যাচ্ছি ওটা নিয়ে ফিরবো। টেসলাটি নীল বর্ণের, গা দিয়ে যেন আলো ঠিকরে বেরোচ্ছে, ফ্রন্ট স্ক্রীনে একটা ইয়াব্বড় আইপ্যাড মতো ফিট করা, ওটাতেই সব দেখা যাবে। কর্তা ভারি খুশী হয়ে গেলেন। যথা সময়ে শোরুমের মহিলা কর্মচারীটি কর্তার হাতে একটা চৌকো বড় কার্ড ধরিয়ে দিলেন, ওটাই নাকি চাবি! কর্তা ড্রাইভ করবেন, আমি রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছি, উনি রওনা দিলেই আমিও পুরনো গাড়িটা নিয়ে বেরিয়ে পড়ব। মহিলা আমাদের অভিনন্দন জানিয়ে “বাই বাই, হ্যাভ এ নাইস ওয়ান” বলে দিলেন। আমিও ভাবছি এবার কর্তাও মুভির হিরোদের মতো সাঁ করে উড়ে বেরিয়ে যাবেন। কিন্তু দশ মিনিট হয়ে গেল উনি তখনও ম্যানুয়াল পড়ছেন, তাও আবার চশমা আনেননি বলে ওটা আমাকেই গছালেন। আমি পৃথিবীর যে কোনো ম্যানুয়াল দেখলেই লং জাম্প দিয়ে পগার পার হই আর এটা আবার হাইটেক গাড়ির! কিছুক্ষণ পরে ওই মহিলা এসে দেখেন গাড়ি তখনও নট নড়ন চড়ন। কাছে এসে বললেন,

“ইজ দেয়ার এনি প্রবলেম?”

“না মানে কি করে স্টার্ট হবে আর অন্যান্য ফিচার্স গুলো একটু দেখে নিচ্ছি।”

কর্তা জানান।

“এই কার্ডটা ওই ডানদিকের বোর্ডের ওপর ঘষে দিয়ে স্টার্ট দিন, তারপর সব কিছুই ওই ফ্রন্ট স্ক্রীনে টাচ করে সিলেক্ট করবেন। পরে মোবাইলে অ্যাপটা ডাউনলোড করে মোবাইল দিয়েই চালাবেন।”

মহিলা বুঝিয়ে দেন, জলবৎ।

কোনোমতে গাড়ি স্টার্ট দিয়ে মহিলার প্রতি কর্তার করুণ প্রশ্ন,

“আচ্ছা রিয়ার ভিউ মিররটা হাত দিয়ে ঘোরাতে পারবো তো?”

দোষের মধ্যে আমি ফিক করে হেসে ফেলেছিলাম এবং ওই মহিলাও।

খুব ভুল করেছিলাম।

এরপর কর্তা ট্যুরে যাবেন, আমাকে একদিন টেসলার ট্রেনিং দিয়ে দিলেন, মোবাইলে অ্যাপ ও ডাউনলোড করলাম। বেশ মজার ব্যাপার, ফোন নিয়ে গাড়ির কাছে এলেই গাড়ি আনলক হয়ে যায় আর দূরে গেলেই লক। উনি চালালেন, আমি মোটামুটি বুঝে নিলাম। এরপর এলো সেই রাত, মেয়েকে গানের স্কুলে নিয়ে যাবো, অন্য গাড়িতে গ্যাস ভরা নেই। ঝটপট টেসলায় স্টার্ট দিলাম, গাড়ি তো নয় যেন পক্ষ্মীরাজ ঘোড়া! সামনের স্ক্রীনে ভিডিও গেমসের মতো আমার ও আশপাশের গাড়ি ফুটে উঠছে, খুব কাছে কেউ এলে বাজনা বাজছে। ভালোই চালালাম (সে নিজেই চললো), শুধু সারা রাস্তা গাড়ি আমাকে গালাগাল দিয়ে গেল অ্যাক্সিলেটর আর ব্রেক একসঙ্গে চেপে রাখার জন্য, বদভ্যাস!

গানের স্কুলে পৌঁছে মেয়ে দৌড় দিলো। আমি এবার পার্ক করবো, কিন্তু তন্নতন্ন করে খুঁজে, গিয়ার স্টিক ঘটঘট করে নাড়িয়েও P অথবা পার্কিং অপশন কোথাও দেখলাম না, N, R, D সব জায়গায় যাচ্ছি, কেবল P বলে কিছু নেই। পরে বুঝলাম কর্তা সেদিনের হাসির বদলা নিতে এই মোক্ষম কথাটাই চেপে গেছিলেন যে গিয়ার স্টিকের শেষ প্রান্তে একটা ছোট্ট গোল সুইচ আছে, ওটা টিপলেই গাড়ি বন্ধ হয়ে যায়!


(নিউ জার্সির অভিব্যক্তির পৌষালী সংখ্যায় প্রকাশিত)

ekhansangbad
Author: ekhansangbad

Related News

Also Read