Select Language

[gtranslate]
৯ই কার্তিক, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ শুক্রবার ২৫শে অক্টোবর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

এক অসামান্য নারী স্বর্ণকুমারী দেবীর জন্মদিনে শ্রদ্ধাঞ্জলী ।

২৮ অগস্ট এক অসামান্য নারী স্বর্ণকুমারী দেবীর জন্মদিন।ঔপনিবেশিক বাংলার সমাজে নারীবিষয়ক প্রশ্নের উত্তর ইনি পুরুষদের থেকে ভিন্ন ভাবে খুঁজেছিলেন। বিশেষত বিধবাদের সম্বন্ধে তাঁর ভাবনা, বা বলা ভাল, বৈধব্যসমস্যার উত্তর এনার কাছে ভিন্ন রকম ছিল। উচ্চারিত হয়েছিল বিকল্প এক সমাধানসূত্র— যা নারীর দেহের থেকেও মন, মনন, স্বাবলম্বন ও আত্মসম্মানকে বেশি গুরুত্ব দিতে চেয়েছিল।

স্বর্ণকুমারী দেবী ছিলেন দ্বারকানাথ ঠাকুরের পৌত্রী এবং দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের চতুর্থ কন্যা।১৮৫৫ খ্রীষ্টাব্দে ২৮ আগষ্ট তিনি জোড়াসাঁকোর ঠাকুর বাড়িতে জন্মগ্রহন করেন।তিনি তার অনুজ ভ্রাতা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চেয়ে পাঁচ বছরের বড়ো ছিলেন।১৮৬৮ সালে জানকীনাথ ঘোষালের সঙ্গে স্বর্ণকুমারী দেবীর বিবাহ হয়। জানকীনাথ ছিলেন নদিয়া জেলার এক জমিদার পরিবারের শিক্ষিত সন্তান।

রবীন্দ্রনাথের জ্যেষ্ঠা ভগিনী স্বর্ণকুমারী দেবী বাংলা সাহিত্যের এক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব। তাঁর সাহিত্য প্রতিভা ছিল বিচিত্রমুখী। উপন্যাস, কবিতা, নাটক, গল্প সাহিত্যের বিচিত্র প্রকরণেই তাঁর পারদর্শিতা সুপ্রমাণিত। সাময়িক পত্র সম্পাদনাতেও তিনি কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখেছেন। তাঁর সম্পাদিত ‘ভারতী পত্রিকা সমকালে বিশেষ গুরুত্বলাভ করেছিল। এককথায় স্বর্ণকুমারী ছিলেন যথার্থই নবজাগরণ যুগের নারী চেতনার প্রতিমূর্তি।

একই সাথে সমাজ সংস্কারক হিসাবে স্বর্ণকুমারি দেবীর অবদানও স্বর্ণাক্ষরে লিখিত আছে । সতীদাহ প্রথা বিলোপসাধনে রামমোহন রায়ের ভূমিকা সর্বজনবিদিত। তিনি সতীদাহকে ‘বিধবাদের জ্যান্ত পুড়িয়ে মারা’র প্রথা হিসেবে পুনঃ-সংজ্ঞায়িত করেছিলেন।রামমোহনের কাছে বিধবাদের জন্য মৃত্যুর বিকল্প ছিল কামনাবাসনাবর্জিত মৃতবৎ এক জীবন।

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বিধবাদের, বিশেষত বালবিধবাদের যৌনতা নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিলেন এবং এই যৌনতাকে বৈধ খাতে বইয়ে দেওয়ার জন্য তিনি পুনর্বিবাহের প্রস্তাব দিয়েছিলেন। চোখে আঙুল দিয়ে দেখাতে চেয়েছিলেন কী ভাবে বিধবাদের জন্য না ভাবার কারণে সমাজ ব্যভিচার, ভ্রূণহত্যা ও বেশ্যাবৃত্তির পাপে নিমজ্জিত। সেই পাপ থেকে সমাজকে উদ্ধার করার একমাত্র পথ হল, পুনর্বিবাহের বৈধকরণ।

একই সময়ে বিধবাদের অস্তিত্বের এই বিপন্নতা নিয়ে ভাবতে শুরু করেছিলেন উনিশ শতকের কয়েক জন মননশীল নারী।স্বর্ণকুমারী দেবীর কাছে বিধবার প্রেম ও পুনর্বিবাহের চাইতেও যেটা বেশি জরুরি মনে হয়, সেটা হল নারীর স্বাবলম্বন, মাথা উঁচু করে বাঁচার সুযোগ। ১৮৯৬ সালে স্বর্ণকুমারী সখী সমিতি স্থাপন করেন। এই সমিতির অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল অসহায় বিধবাদের শিক্ষিত করে স্বনির্ভর করে তোলা। বিশেষত, অন্তঃপুর শিক্ষয়িত্রী হিসেবে তাদের নিযুক্ত করা।স্বর্ণকুমারীর কাছে পুনর্বিবাহ ঐচ্ছিক, সসম্মানে বেঁচে থাকার জন্য অপরিহার্য নয়। অপরিহার্য হল শিক্ষা ও স্বাবলম্বন।

সংগঠন পরিচালনা কেবলমাত্র সদস্যদের চাঁদায় সম্ভব নয় অনুভব করে, স্বর্ণকুমারী দেবী বেথুন কলেজে একটি বার্ষিক মেলার আয়োজন করেন। এই মেলায় ঢাকা ও শান্তিপুরের শাড়ি, কৃষ্ণনগর ও বীরভূমের হস্তশিল্প এবং বহির্বঙ্গের কাশ্মীর, মোরাদাবাদ,  বারাণসী, আগ্রা , জয়পুর ও বোম্বাইয়ের হস্তশিল্প প্রদর্শিত হয়।তার উদ্দেশ্য ছিল ভারতের দেশজ পণ্যের প্রদর্শনী ও বিক্রয়ের ব্যবস্থা করা। সেই যুগে এই মেলা কলকাতার সমাজে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল।

“সখীসমিতি” নামটি রবীন্দ্রনাথের দেওয়া। সরলা রায়ের অনুরোধে সখীসমিতির অর্থসংগ্রহের উদ্দেশ্যে রবীন্দ্রনাথ “মায়ার খেলা” নৃত্যনাট্যটি লিখে মঞ্চস্থ করেছিলেন।

স্বর্ণকুমারী দেবীই ছিলেন প্রথম বাঙালি মহিলা ঔপন্যাসিক।১৮৭৬ সালে স্বর্ণকুমারী দেবীর প্রথম উপন্যাস দীপনির্বাণ প্রকাশিত হয়।দীপনির্বাণ ছিল জাতীয়তাবাদী ভাবে অনুপ্রাণিত এক উপন্যাস। এরপর স্বর্ণকুমারী দেবী একাধিক উপন্যাস, নাটক, কবিতা ও বিজ্ঞান-বিষয়ক প্রবন্ধ রচনা করেন।

১৮৭৯ সালে স্বর্ণকুমারী দেবী প্রথম বাংলা গীতিনাট্য (অপেরা) বসন্ত উৎসব রচনা করেন। পরবর্তীকালে তার অনুজ রবীন্দ্রনাথ এই ধারাটিকে গ্রহণ করে সার্থকতর গীতিনাট্য রচনায় সফল হয়েছিলেন

স্বর্ণকুমারী দেবী তিন শতাধিক গানের রচয়িতা। ঠাকুরবাড়ির সদস্যদের মধ্যে গান রচনার সংখ্যার দিক থেকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পর স্বর্ণকুমারীর স্থান।

স্বর্ণকুমারী দেবীর স্বামী ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সেক্রেটারি ছিলেন। তিনি নিজেও সামাজিক সংস্কার ও জাতীয়তাবাদী রাজনীতির সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন। ১৮৮৯ ও ১৮৯০ সালে পণ্ডিতা রামাবাই, রামাবাই রানাড ও কাদম্বিনী গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে তিনিও জাতীয় কংগ্রেসের বার্ষিক অধিবেশনে অংশ নেন। তিনিই ছিলেন প্রথম মহিলা যিনি জাতীয় কংগ্রেসের অধিবেশনে প্রকাশ্যে অংশগ্রহণ করেছিলেন।

আজ ইন্টারনেট যুগের বহু বহু যুগ আগে স্বর্ণকুমারী দেবী অবলা বিধবাদের বেঁচে থাকাকে অর্থবহ করে তুলতে চেয়েছিলেন। অপ্রতিরোধ্য সমাজবিনাশী এক তীব্র যৌনকামনার আধারের পরিবর্তে বিধবা নারীকে দেখেছিলেন তার মেধা, বুদ্ধিবৃত্তি অবলম্বন করে, কারও দয়ায় না বেঁচেও জীবনের পথে দিব্যি এগিয়ে যেতে পারার মতো সম্পূর্ণ মানুষ হিসাবে। শিক্ষাবঞ্চিত গ্রাম-গঞ্জের মেয়েদের এগিয়ে যেতে আলাদা ভাবে সাহায্য করার কথাও তিনি ভেবেছিলেন। তাঁর মনে হয়েছিল, এ ভাবেই এক উন্নততর সমাজের স্বপ্ন বাস্তবায়িত হতে পারে। স্বর্ণকুমারী দেবীর জন্মদিন উপলক্ষে তাঁর ভাবনাকে কুর্নিশ জানায় এখন সংবাদ পরিবার।

ekhansangbad
Author: ekhansangbad

Related News