Select Language

[gtranslate]
১৯শে জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ রবিবার ২রা জুন, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

।। মানস কন্যা‌ ।।

মনোজ কান্তি সেন গুপ্ত :- টিফিন টাইম । মাধ্যমিক গার্লস স্কুলের শিক্ষিকারা এই সংক্ষিপ্ত সময়টুকু নিজেদের মধ্যে হাসি মস্করা ,খাবার শেয়ার করার মধ্য দিয়ে সারাদিনের সব ক্লান্তি দূর করার রসদ পায়। আনন্দ চেটেপুটে খায় । আজও তেমনই চলছিল। হঠাৎ একটা শোরগোলের আওয়াজ এল। কান খাড়া করতেই বোঝা গেল ক্লাস এইট বি সেকশন থেকে এই শব্দটা আসছে। ঐ ক্লাসের ক্লাস টিচার বৈশাখী ম্যাডাম । তাড়াতাড়ি খাবার রেখে বোতল থেকে ঢক ঢক করে মুখে জল ঢেলে ক্লাসে এসে দেখে তুমুল ঝগড়া , চেঁচামেচি চলছে — তৃষ্ঞা এবং আরও দুটি মেয়ে মিলে রিক্তার চুলের মুঠি ধরে ওকে মারছে। রিক্তা কিন্তু নীরব। শুধু দুই হাত দিয়ে ওদের মারধরগুলো অসহায় ভাবে আটকানোর চেষ্টা করছে । কিন্তু এই শীর্ণ শরীরে বৃথা চেষ্টা । ওর ঠোঁটের কোণে ওদের বিক্রমের চিহ্ন এঁকে দেয়। রক্ত গড়িয়ে পড়ছে । বাকী মেয়েরা নীরব দর্শক হয়ে ব্যাপারটা উপভোগ করছে ।
বৈশাখী ম্যাডাম ঘরে ঢুকেই এই দৃশ্য দেখে চিৎকার করে ওঠে — এ কী অসভ্যতা হচ্ছে ?
তৃষ্ণা তখনো রিক্তার চুলের মুঠি ধরে ওকে মারছে । ম্যাডাম চিৎকার করে ওঠে — এখনই ছেড়ে দাও রিক্তাকে নতুবা তোমাকে সাসপেন্ড করা হবে ।
চকিতে শান্ত হয় ক্লাস । তৃষ্ণাকে কাছে ডেকে ম্যাডাম জিজ্ঞেস করে — কেন ওকে মারছিলে ?


তৃষ্ণা তখনো রাগে ফুঁসছে । বলে — ও চোর । আমার টিফিন চুরি করে খেয়েছে । ওকে জিজ্ঞেস করলাম — তুই খেয়েছিস? ও বলল — হ্যাঁ। তাই ওকে মেরেছি । ও আমার খাবার কেন খেয়ে নিল ? আমি তবে কী খাব ?
ম্যাডাম বলল , তুমি ওকে ও ভাবে না মেরে টিচার্স রুমে আমাকে বা হেড মিস্ট্রেসকে বলতে পারতে। এটা ঠিক কর নি । রিক্তাকে এবার ডাকে বৈশাখী ম্যাডাম। বলে — ও যা বলছে তা সত্যি ?
— হ্যাঁ ম্যাডাম ।
— কেন ওর খাবার খেয়েছ ?
— খুব ক্ষিধে পেয়েছিল। ওকে সে কথা বলেছিলাম। ও বলল — কিনে খা- গে। খাবার আনিস নি কেন ?


বৈশাখী ম্যাডাম লক্ষ্য করল মেয়েটি এত মার খেয়েও মিথ্যে বলেনি। ভালো লাগল ওর সততা দেখে । কিন্তু তখনো ওর ঠোঁটের কোণ বেয়ে রক্ত জ ঝড়ছে । আগে ওর চিকিৎসা দরকার । বৈশাখী ম্যাডাম রিক্তাকে বলল , তুমি আমার সঙ্গে টিচার্স রুমে এস ।
রিক্তা ম্যাডামের পিছে পিছে ভয়ে কাঁদতে গেল। টিচার্স রুম তখন ফাঁকা । ক্লাস শুরুর ঘণ্টা পড়ে গেছে । তবে এই পিরিয়ডটায় বৈশাখী ম্যাডামের কোন ক্লাস নেই। মেয়েটির মুখ পরিষ্কার করে মেডিসিনের কিট থেকে ওষুধ বের করে লাগিয়ে দিয়ে রিক্তাকে একটা চেয়ারে বসায়। তারপর ওর মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলে — এর আগেও কি তুমি কখনো কারও খাবার চুরি করেছ ? যা বলবে সত্য বলবে — নতুবা চুরির অপরাধে স্কুলে আসা বন্ধ করে দেব।
রিক্তা ভয়ে কেঁদে ওঠে । সজোরে মাথা নেড়ে বলে — না ম্যাডাম এর আগে কখনও কারো খাবার চুরি করে খাই নি।


ম্যাডাম ওকে সান্ত্বনা দিয়ে বলে , ভয় পেও না। তুমি যে ওর খাবার খেয়েছ এবং অস্বীকার করনি এজন্য বুঝেছি তুমি মিথ্যেবাদী বা চোর নও । কিন্তু কেন এমন করলে ?
রিক্তা চুপ করে থাকে । ম্যাডাম বলে– ভয় নেই বল ।
— দু’দিন ধরে খেতে দেয় নি তাই ।
— কেন শরীর খারাপ ?
— না, আমাকে নতুন মা দু’দিন ধরে খেতে দেয় নি ।
— নতুন মা !
— আমার নিজের মা নেই । মারা গেছে । মা মারা যাওয়ার পর বাবা দ্বিতীয় বিয়ে করেছে ।
— ও! তা খেতে দেয় নি কেন ? কী অন্যায় করেছ ?


— আমি পড়াশুনা করতে চাই, তাই । দু’দিন আমার বই খাতা সরিয়ে রেখে আমাকে দিয়ে রান্না , কাপড় কাচা ,বাসন মাজা , ঘর মোছা এসব করিয়েছে । কিন্তু আমি বই গুলো ফেরৎ দিতে বলায় আমাকে খেতে দেয় নি । খুব কান্নাকাটি করছি দেখে বিরক্ত হয়ে আজ রেগে বই খাতাগুলো একটা ব্যাগে ভরে আমাকে দিয়ে বলেছে — দূর হয়ে যা এখান থেকে। আর এ বাড়ি মুখো হবি না । এলে ঠ্যাং খোঁড়া করে দেব।……বলে হু হু করে কাঁদতে থাকে রিক্তা । তারপর হঠাৎ বলে — এখন কোথায় যাব ম্যাডাম ? এই স্কুলে একটু থাকতে দেবে?
বৈশাখী ম্যাডাম কিছুক্ষণের জন্য বাকরুদ্ধ হয়ে পড়ে । ওর ব্যথাটা যেন নিবিড় ভাবে নিজের বুকে এসে বেঁধে । কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ে কিছুক্ষণের জন্য । বুকে টেনে নেয় মেয়েটিকে সজোরে । বৈশাখী এবং রিক্তার ব্যথা যেন মিলে মিশে একাকার হয়ে যায় ।


হঠাৎই সম্বিৎ ফিরে আসে হেড মিস্ট্রেসের কথায় — এ কী ! মেয়েটিকে এভাবে জড়িয়ে ধরে কাঁদছ ! ? ও ক্লাস এইট বি -তে পড়ে না? ক্লাস ছেড়ে ও এখানে কেন ?
বৈশাখী তাড়াতাড়ি নিজেকে সামলে নিয়ে বলে , না ম্যাডাম, ওকে এখনই ক্লাসে দিয়ে আসছি । পরে আপনাকে সবটা বলব ।


তারপর রিক্তাকে সঙ্গে করে ক্লাসে নিয়ে যেতে যেতে বলল — স্কুল ছুটি হলে আমার সঙ্গে দেখা করো । আমি তোমার একটা ব্যবস্থা করে দেব।
স্কুল ছুটি হতেই রিক্তা বইয়ের ব্যাগটা সঙ্গে নিয়ে স্কুলের গেটের বাইরে এসে দাঁড়ায় । একে একে স্কুলের মেয়েরা এবং টিচাররা বেরিয়ে যায় কিন্তু বৈশাখী ম্যাডামের দেখা নেই । অনেকক্ষণ পরে ম্যাডাম চারপাশে তাকাতে তাকাতে স্কুল থেকে বের হয়ে ওকে দেখতে পেয়েই বলল — এ কী তুমি এখানে দাঁড়িয়ে ? আমি খুঁজে বেড়াচ্ছি তোমাকে ?


— টিচার্স রুমে ভয়ে যাই নি। আমাকে ওখানে দেখে বড় ম্যাডাম যদি আপনাকে আবার বকেন?
ম্যাডাম সস্নেহে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে বলল — চল , এখন থেকে তুমি আমার বাড়িতে থাকবে । রাজি ? পড়াশুনা করবে ।
রিক্তার চোখ আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে উঠল । কিন্তু হঠাৎই আবার ভয় হল ।বলল — এর জন্যে বাড়ির অন্য কেউ আপনাকে কিছু বলবে না তো ?


বৈশাখী ওর কাঁধে হাত রেখে বলল — সে চিন্তা তোমার করতে হবে না । ওটা আমার উপর ছেড়ে দাও ।
কী জানি কী হল হঠাৎই রিক্তা ম্যাডামের পা ছুঁয়ে প্রণাম করল।
— আরে ! আরে ! এ কী করছ !! …… তারপরই রিক্তাকে বলল — আজ থেকে তোমাকে ‘তুমি ‘ নয় ‘ তুই’ করে বলব । কেমন ? …… রিক্তা সানন্দে ঘাড় নাড়ল ।


দু’জনারই রুক্ষ, শুষ্ক জীবনে শ্রাবণের স্নিগ্ধ সজল মেঘ যেন তার সকল ভালোবাসা দিয়ে স্নেহের বারি সিঞ্চন করে দিল ।
বৈশাখীও বড্ড একা । কৃশ ,শ্যামাঙ্গী মেয়েটির মায়া ভরা চোখ দুটোয় যেন আনন্দের জোয়ার , কৃতজ্ঞতায় ভরা । বৈশাখী ওকে বুকে তুলে নেয়। নিজের সন্তান নয় , তবু যেন ওকে বুকে তুলে পরম তৃপ্তি , মাতৃত্বের স্বাদ । বৈশাখী ভাবে যে বয়সে ওর বিয়ে হয়েছিল — তাতে ওর এই বয়সীই সন্তান থাকত । সেই স্মৃতিকে সে বহন করতে চায় না , অথচ সেই স্মৃতিই যেন এই মুহূর্তে ভেসে উঠল মনের পর্দায় ।


বৈশাখী ভীষণ স্টুডিয়াস ছিল । পড়াশুনায় তুখোড় । অতি সুন্দরী না হলেও ওর বুদ্ধিদীপ্ত চোখ এবং সংযত ব্যবহার ও সীমিত বাক্য প্রয়োগ ওকে ভীষণ রকম মার্জিত করে তোলে। সাধারণের চোখে ও তাই ব্যতিক্রমী । ওর বয়সী ছেলেরা বা মেয়েরা তাই ওকে সমীহের চোখে দেখত ।
তবুও হয়তো প্রকৃতির নিয়মে বা যৌবনের চাহিদায় মনের কুঠুরিতে লুক্কায়িত কোন রাসায়নিক দ্রবণ সোনম আর বৈশাখীকে কখন যুক্ত করে দিল ।


সোনম সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার। অত্যন্ত সুপুরুষ। বহু মেয়েরই কাঙ্ক্ষিত । বৈশাখীর ইউনিভার্সিটিতে যাতায়াতের পথে ওদের পরিচয়, হৃদ্যতা — ধীরে ধীরে তা প্রেমে দ্রবণ। পরিশেষে বিবাহে সমাপন। উভয়ের বাড়ি থেকেই বলেছে — তোমরা সাবালক ,বিচক্ষণ । নিজেরা নিজেদের বুদ্ধি বিবেচনায় যেটা ঠিক করেছ তাতে আমাদের আপত্তি নেই । এর ভালো বা মন্দর দায় থাকবে একান্ত ভাবেই তোমাদের। তবে আশা করব মন্দ হবে না ।


ভালোলাগা , ভালোবাসার উন্মাদনায় দু’জনই তখন মাতাল। তবু জীবন বৈচিত্র্যে পরিবর্তন আসে । প্রভাত একসময় মধ্যাহ্ণে গড়ায় , মধ্যাহ্ণ অপরাহ্নে ……. ।


বিয়ের পর এ বাড়ি থেকেই বি এড শেষ করে বৈশাখী চাকরি পেয়ে যায় দূরে — ঝাড়গ্রামে । মনটা দোনামনা করলেও চাকরিটা ছাড়তে বৈশাখী একেবারেই রাজি নয় । সোনমের ঘোর আপত্তি । বলে — তোমার চাকরি করতে হবে না। আমি যা রোজগার করি তাতে আমাদের চলে যাবে ।


বৈশাখীর তখন ক্ষুধার্ত ব্যাঘ্রের রক্তের স্বাদ পাওয়ার মত অবস্হা । সোনম বলে , তুমি সপ্তাহে হয়তো একবার আসতে পারবে । কখনো হয়তো তাও নয় । তাহলে এই বিয়ে করার দরকার কী ছিল — স্বামী স্ত্রী আলাদা থাকার জন্য নিশ্চয় নয় ।


কিন্তু বৈশাখী এসব শোনে না। সোনম ওর ঝাড়গ্রাম যাওয়ার দিন বলে — আমার কথা শুনলে না ।এর পরের ফলাফলের জন্য আমাকে যেন দায়ী করো না ।
বৈশাখী বলে — এত বছর ধরে এত পড়াশুনা করে চাকরিটাই যদি না করি তবে এত পরিশ্রম করলাম কেন ? তুমি কি তোমার চাকরি ছেড়ে আমার ওখানে যেতে পারবে ?
সোনম বলে — স্বামীরই যে কর্তব্য স্ত্রীর ভরণ পোষণের সব দায়িত্ব বহন করা । তাই আমি চাকরি ছাড়ব কী করে ?
দুই বিপরীত মুখী তর্কের যানের দূরত্ব একসময় বাড়তে বাড়তে দৃশ্যপট থেকে হারিয়ে যায় দূরে অনেক দূরে । পরিণতি বিবাহ বিচ্ছেদে।
সেই থেকেই বৈশাখী সম্পূর্ণ একা ।
আট বছর ঝাড়গ্রামে কাজ করার পর হঠাৎই সুযোগ এসে গেল কলকাতার এই স্কুলে বদলি হয়ে আসার ।
বৈশাখী সোনমকে দোষ দেয় না । এটাই হয়তো ওদের ভবিতব্য ছিল ।
ঐ নিঃসঙ্গ ,মাতৃহারা , গৃহ পরিত্যক্তা মেয়েটিকে বুকে টেনে নিয়ে বৈশাখী ভাবে– আমিও তো নিঃসঙ্গ। ঈশ্বরই তাই ওকে প্রেরণ করেছেন। নাই বা হল ও আমার গর্ভস্হ সন্তান– তবু রিক্তাই আমার সন্তান– আমার মানস কন্যা। ওকে আপন সন্তানের মত মানুষ করে তুলব ।

ekhansangbad
Author: ekhansangbad

Related News

Also Read