ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের সর্বাধিনায়ক নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু ছিলেন তাঁর শিষ্য, খোদ স্বামী বিবেকানন্দ তাকে পাশ্চাত্যে বেদান্তের বাণী প্রচারের কাজে নিযুক্ত করেছিলেন।সবচেয়ে বড় কথা হল তিনিই ছিলেন শ্রী শ্রী ঠাকুর রামকৃষ্ণ পরমহংসের শেষ সাক্ষাৎশিষ্য।সেই তিনি হলেন স্বামী অভেদানন্দ।
স্বামী অভেদানন্দের পূর্বাশ্রমের নাম ছিল কালীপ্রসাদ চন্দ্র। তিনি ১৮৬৬ সালের ২ অক্টোবর উত্তর কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন।তার পিতার নাম ছিল রসিকলাল চন্দ্র ও মাতার নাম ছিল নয়নতারা দেবী।
বাল্যকাল থেকেই অভেদানন্দের ধর্মের প্রতি বিশেষ অনুরাগ ছিল; প্রথম যৌবনে হিন্দুশাস্ত্রাদি অধ্যয়নে সে অনুরাগ আরও বৃদ্ধি পায়। ওই সময় রেভা. ম্যাকডোরেন্ড, রেভা. কালীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ খ্রিস্টান ধর্মপ্রচারকদের সান্নিধ্যের ফলে খ্রিস্টধর্মের প্রতিও তিনি অনুরাগী হয়ে পড়েন।পাশাপাশি কেশবচন্দ্র সেন, প্রতাপচন্দ্র মজুমদার প্রমুখ ব্রাহ্মনেতার বক্তৃতা এবং বিশিষ্ট দার্শনিক শশধর তর্কচূড়ামণির ষড়দর্শনের আলোচনা শুনে হিন্দুদর্শনের প্রতিও তিনি বিশেষভাবে আকৃষ্ট হন। পন্ডিত কালীবর বেদান্তবাগীশের নিকট পতঞ্জলির যোগসূত্র অধ্যয়ন করে তিনি হঠযোগ ও রাজযোগ চর্চা করেন।
এ সময় তিনি দক্ষিণেশ্বরে শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের সান্নিধ্য লাভ করেন। ১৮৮৪ সালে আঠারো বছর বয়সে স্কুল ফাইনাল পরীক্ষা দেওয়ার পূর্বে দক্ষিণেশ্বরে শ্রী শ্রী ঠাকুর রামকৃষ্ণ পরমহংসের সঙ্গে তার সাক্ষাৎ ঘটে। ১৮৮৫ সালের এপ্রিল মাসে গৃহত্যাগ করে তিনি রামকৃষ্ণ দেবের কাছে চলে এসেছিলেন। প্রথমে শ্যামপুকুর ও পরে কাশীপুর উদ্যানবাটীতে শ্রী শ্রী ঠাকুর রামকৃষ্ণ পরমহংসের শেষ অসুস্থতার সময় কালীপ্রসাদ তার সঙ্গে ছিলেন।রামকৃষ্ণের মৃত্যুর পর তিনি স্বামী বিবেকানন্দ ও অন্যান্য গুরুভ্রাতাদের সঙ্গে সন্ন্যাস গ্রহণ করেছিলেন। সন্ন্যাস জীবনে তার নাম হয়েছিল “স্বামী অভেদানন্দ”।
স্বামী বিবেকানন্দের আহ্বানে ১৮৯৬ সালে তিনি ইংল্যান্ড গেলে সেখানে তাঁর পরিচয় ঘটে পল ডয়সন, ম্যাক্সমুলার প্রমুখ মনীষীর সঙ্গে। ইংল্যান্ডে তিনি রাজযোগ, জ্ঞানযোগ ও বেদান্ত সম্পর্কে নিয়মিত বক্তৃতা দেন। সেখান থেকে ১৮৯৭ সালে আমেরিকা গিয়ে তিনি নিউইয়র্কের বেদান্ত আশ্রমের দায়িত্ব গ্রহণ করেন।তিনি হিন্দুধর্ম ও ভারতীয় দর্শন প্রচারের উদ্দেশ্যে আমেরিকা, কানাডা, মেক্সিকো, জাপান, হংকং প্রভৃতি দেশ ভ্রমণ করেন। ১৯২১ সালে হনলুলুতে প্যান-প্যাসিফিক শিক্ষা সম্মেলনে যোগদানের পর তিনি ভারতে প্রত্যাবর্তন করেন। ১৯২২ সালে কাশ্মীর হয়ে তিব্বত যাওয়ার পথে লাকাদের বৌদ্ধ মন্দির হেমিসগুম্ফায় তিনি যিশুখ্রিস্টের অজ্ঞাত জীবনীর কিছু অংশ উদ্ধার করেন। এটি তাঁর জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ। পরে তাঁর এ মূল্যবান আবিষ্কার তাঁর “কাশ্মীর ও তিব্বত” গ্রন্থে প্রকাশিত হয়। ১৯২৩ সালে কলকাতায় ফিরে তিনি ‘শ্রীরামকৃষ্ণ বেদান্ত সোসাইটি’ এবং ১৯২৪ সালে দার্জিলিঙে ‘শ্রীরামকৃষ্ণ বেদান্ত আশ্রম’ প্রতিষ্ঠা করেন।নিবেদিতা মারা গেলে ১৯২৫ সালে স্বামী অভেদানন্দ দার্জিলিঙে তাঁর সমাধিক্ষেত্রে স্মৃতি মন্দিরটি তৈরি করে দেন।
পৃথিবী জুড়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বাতাবরন তৈরি হচ্ছে সেই সময় অভেদানন্দ খুব অসুস্থ। একদিন হঠাৎ করে এক শিষ্যকে ডেকে বললেন, “আমার সুভাষকে বড় দেখতে ইচ্ছে করছে। ওর কাছে খবর পাঠানোর ব্যবস্থা কর।”
খবর পেয়েই ছুটে এলেন সুভাষ। অভেদানন্দ তখন পুরোপুরি শয্যাশায়ী। ঠিকমতো উঠে বসতেও পারেন না। সুভাষকে দেখে উঠে বসলেন। সুভাষকে দেখে অভেদানন্দের আনন্দ আর ধরে না। সুভাষকে বললেন, “সুভাষ তোমায় একবার আলিঙ্গন করি।” সুভাষকে বুকে জড়িয়ে ধরে বললেন, “বিজয়ী ভব।”
গুরুর আশির্বাদে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের সর্বাধিনায়ক সুভাষের চোখে তখন জল।
১৯৩৯ সালের ৮ সেপ্টেম্বর। চলে গেলেন জ্ঞানদীপ্ত সন্ন্যাসী অভেদানন্দ। কলকাতার শ্রীরামকৃষ্ণ বেদান্ত মঠে নেমে এল শোকের ছায়া। অভেদানন্দের ইচ্ছানুসারে কাশীপুর শ্মশানে শ্রীরামকৃষ্ণের সমাধিস্থলের সামনে তাঁর শেষকৃত্য সম্পন্ন হয়।
স্বামী অভেদানন্দ হিন্দুধর্ম সম্পর্কে অনেক গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ রচনা করেন। এগুলির মধ্যে: Gospel of Ramakrishna, Reincarnation, How to be a Yogi, India and her People, আত্মবিকাশ, বেদান্তবাণী, হিন্দুধর্মে নারীর স্থান, মনের বিচিত্র রূপ প্রভৃতি উল্লেখযেগ্য। তিনি বিশ্ববাণী নামে একটি মাসিক পত্রিকা প্রকাশ করেছিলেন, যা ১৯২৭-১৯৩৮ সাল পর্যন্ত তাঁর সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়।
জীবনের শেষ দিন অবধি বিশ্ব জুড়ে ভারতীয় দর্শনের প্রচারক স্বামী অভেদানন্দ মহারজকে এখন সংবাদ পরিবারের শতকোটি প্রণাম